ঢাকা, ১৫ জুন ২০২৫:
দীর্ঘ এক সময়ের অপেক্ষার পর যখন বাংলাদেশ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে কিছুটা স্বস্তি পেতে শুরু করেছিল, তখনই নতুন করে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯-এর নতুন ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) দেশজুড়ে স্বাস্থ্যখাতসহ সকল স্তরে উদ্বেগ তৈরি করেছে। গত কয়েক সপ্তাহে দেশে হঠাৎ করেই করোনা সংক্রমণ বেড়ে গেছে, যা বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি সম্ভাব্য নতুন ঢেউয়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি ও বৈশিষ্ট্য
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সনাক্ত হওয়া নতুন ধরনটি ‘KP.3’ কোডনামে চিহ্নিত, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নজরদারিতে থাকা ‘উদ্বেগজনক ধরন’ (Variant of Interest) তালিকাভুক্ত। এটি পূর্বের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের একটি পরিবর্তিত রূপ, তবে এতে সংক্রমণ ক্ষমতা অনেক বেশি এবং ইনকিউবেশন পিরিয়ড (অর্থাৎ শরীরে প্রবেশ করার পর উপসর্গ দেখা দেওয়ার সময়) তুলনামূলকভাবে ছোট।
এই নতুন ধরনে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে সাধারণত জ্বর, কাশি, গলা ব্যথা, মাথা ঘোরা ও ক্লান্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপসর্গ তুলনামূলকভাবে হালকা, তবু বয়সভিত্তিক ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী যেমন বয়স্ক, শিশুরা এবং যাদের আগেই শ্বাসযন্ত্র বা হৃদরোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে জটিলতা দেখা যাচ্ছে।
সংক্রমণের বর্তমান অবস্থা
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কোভিড রোগীর সংখ্যা গত দুই সপ্তাহে প্রায় ৪৮% বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিদিন গড়ে ২৫০-৩০০ জন নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী এবং সিলেটেও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেছেন,
> “আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। বর্তমানে শনাক্তের হার ১২.৭%, যা উদ্বেগজনক। যদি জনগণ স্বাস্থ্যবিধি না মানে, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।”
জনগণের মাঝে সচেতনতার অভাব
টিকাদান কর্মসূচির সফলতা এবং সংক্রমণ কমে যাওয়ায় মানুষজন ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণে অনীহা দেখাতে শুরু করে। অধিকাংশ স্থানেই এখন আর মাস্ক ব্যবহার করতে দেখা যায় না, বাজার-ঘাট, গণপরিবহন ও অফিসে শারীরিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না বললেই চলে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনস্বাস্থ্য বিভাগের অধ্যাপক ডা. রুবায়েত হাসান বলেন,
> “এটা খুবই দুঃখজনক যে, আমাদের অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও আমরা পুরনো ভুলগুলোই আবার করছি। এই ভাইরাস যতবার রূপ পরিবর্তন করে, ততবারই আমাদের নতুন করে প্রস্তুত হতে হয়। জনগণকে এখনই সতর্ক হতে হবে।”
সরকারি পদক্ষেপ ও প্রস্তুতি
সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কিছু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যেমন:
বুস্টার ডোজ কর্মসূচি পুনরায় চালু করা হয়েছে।
মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে বিবেচনা চলছে।
বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে স্ক্রিনিং ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
স্কুল-কলেজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান চালানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এছাড়াও, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর প্রতিটি বিভাগীয় শহরে কোভিড-১৯ রেসপন্স টিম গঠন করেছে যারা সন্দেহভাজন রোগীদের দ্রুত চিহ্নিত করে আইসোলেশনে রাখার কাজ করছে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় চাপ
হাসপাতালগুলোর উপর চাপ বাড়ছে। অনেক বেসরকারি হাসপাতাল এখন আবার করোনা ইউনিট চালু করতে শুরু করেছে। সরকারিভাবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে ফিল্ড হাসপাতালও, যেগুলো আবার কার্যকর করার পরিকল্পনা চলছে।
তবে সবচেয়ে বড় সংকট দেখা দিয়েছে টেস্টিং ক্যাপাসিটি নিয়ে। বহু মানুষ এখনো পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা বুঝছেন না অথবা সহজলভ্য না হওয়ায় পরীক্ষা করাচ্ছেন না, যা সংক্রমণ চেইন ভাঙতে বড় প্রতিবন্ধক।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মুহূর্তে চারটি জিনিস জরুরি:
1. জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা
2. স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানা
3. বুস্টার ডোজ গ্রহণ নিশ্চিত করা
4. টেস্টিং ও কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং জোরদার করা
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও (WHO) বাংলাদেশকে উচ্চ সতর্কতায় থাকার পরামর্শ দিয়েছে। একইসাথে সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে, যাতে বাইরের দেশ থেকে নতুন ভ্যারিয়েন্ট ছড়াতে না পারে।
উপসংহার
কোভিড-১৯ এর এই নতুন ঢেউ বাংলাদেশের জন্য একটি সতর্কবার্তা। আমরা অতীতে একাধিকবার প্রমাণ করেছি যে সম্মিলিত প্রয়াসে সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু এই মুহূর্তে যে অস্থিরতা এবং উদাসীনতা দেখা যাচ্ছে, তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
এখনই সময় — ব্যক্তিগত ও সামাজিকভাবে আমরা যেন আবার সচেতন হই, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি এবং সরকারকে সহযোগিতা করি। নইলে একটি নতুন বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে আমাদের বেশি সময় লাগবে না।
---
প্রতিবেদন: সংবাদ ডেস্ক, ঢাকা
তারিখ: ১৫ জুন, ২০২৫
0 Comments